আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো আর ঢাকায় থাকব না
‘ডাক্তার যখন বললেন, ছেলের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। তখন মনে হল আমার পৃথিবীর একপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। তারপরও নিজের মধ্যেই সান্ত্বনা খুঁজছিলাম। যাক ছেলেটা অন্তত বেঁচে আছে। এটাই বা কম কিসে। চোখ গেলেও সন্তান তো ফিরে পেয়েছি। আমার মানিক এভাবেই না হয় বেঁচে থাক! কিন্তু একেবারেই আমাকে ছেড়ে চলে গেল! আর কোনোদিন আমাকে আম্মু বলে ডাকবে না।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ চত্বরে এভাবেই বুকফাটা আহাজারি করছিলেন মা নুরজাহান বেগম। তার ছেলে সানজিদ হোসেন অভি ১৪ জানুয়ারি দুর্বৃত্তদের হাতবোমা বিস্ফোরণে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল। বুধবার রাত ১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।< অভি ভর্তি ছিল হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে। ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কোচিং শেষ করে হেঁটে বন্ধু হৃদয়ের সঙ্গে ধোলাইখাল কলতাবাজারের বাসায় ফিরছিল কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র অভি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বঙ্গবাজারে পৌঁছলে দুর্বৃত্তদের হাতবোমা হামলায় তারা আহত হয়। আশপাশের লোকজন উদ্ধার করে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে হৃদয় বাসায় ফেরে। ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় অভিকে। ওই রাতেই চিকিৎসক জানান, অভির বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। আহত হওয়ার পর থেকেই ছেলের পাশে ছিলেন মা নুরজাহান। মন দুরু দুরু করত, ছেলে বাঁচবে তো! অভি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ছটফট করত। সে নিজেই টান দিয়ে মুখের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছিল। বেড থেকে উঠে পালিয়ে যেতে চাইত। বুধবার সকালে অভি নিচু স্বরে মায়ের সঙ্গে শেষবার কথা বলেছিল। নুরজাহান বেগম যুগান্তরকে বলেন, আমি ছেলেকে বলেছিলাম, তুই আমাকে খুব জ্বালাচ্ছিস। তখন অভি বলেছিল, আম্মু আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। আর ঢাকায় থাকব না। ওয়ার্ডের অন্য রোগীর স্বজনরা জানান, বুধবার রাত ১টার দিকে চিকিৎসকের কাছ থেকে অভির মারা যাওয়ার খবর শোনার পর বুকফাটা আর্তনাদ শুরু করেন নুরজাহান। অভিযোগ তোলেন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। রাত পৌনে ১২টায় এক চিকিৎসক অভিকে আইসিইউতে নেয়ার পরামর্শ দিলেও তাকে নেয়া হয়নি সেখানে। নুরজাহান বলেন, ডাক্তারদের অনেক অবহেলা ছিল। চিকিৎসাপত্র নিয়ে গেলে ঠিকমতো দেখত না। একটা ফাইল অনেক জায়গায় ঘুরাতো ডাক্তার-নার্সরা। অভির বাবা দেলোয়ার হোসেন জানান, তার তিন সন্তান। এর মধ্যে বড় মেয়ে সালমা তিন মাস আগে সন্তান প্রসবের সময় মারা যায়। দ্বিতীয় সন্তান ছিল অভি। ছোট ছেলে সানজুর বয়স দেড় বছর। তাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার আটপাড়ায়। ঢাকার ধোলাইখালের কলতাপাড়ায় থাকেন তারা। তিনি বিকালে সদরঘাটে ডিম বিক্রি করেন এবং সকালে কলতাবাজার এলাকায় সবজি বিক্রি করেন। তিনি জানান, অভির পড়ালেখার খরচ চালাতে তার কষ্ট হতো। তাই অভি দেড় হাজার টাকা বেতনে পুরান ঢাকায় একটি কম্পিউটার দোকানে খণ্ডকালীন চাকরি আর দুটি টিউশনি করত। এদিকে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে লাশের ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নেয়া হয়। অভির মা ময়নাতদন্ত করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মামলার প্রয়োজনে তা করতে হয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অভির হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে নুরজাহান বলেন, ‘আমার ছেলে চলে গেছে। আমি বুঝছি। আমি কিছু চাই না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটাই দাবি- আমার ছেলেকে যারা বোমা মেরে হত্যা করেছে, তাদের বিচার করা হোক। আমার মতো আর কোনো মায়ের কোল যেন ওরা খালি করতে না পারে।www.24banglanewspaper.com