রাজধানীর
রামপুরায় একটি দোতলা টিনশেড ঘর ঝিলে দেবে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন একই
পরিবারের ৩জনসহ কমপক্ষে ১২ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ৩০ জন। রামপুরা থানার
পূর্ব হাজীপাড়া এলাকায় বৌবাজার মাটির মসজিদ সংলগ্ন বেগের বাড়ি ঝিলের
(খাসজমি) ওপর অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল এই দোতলা টিনের ঘরটি। সেখানে ছিল
২৪টি কক্ষ। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা বাশের সাঁকো পেরিয়ে যেতে হয় এই ঘরে। বুধবার
বেলা ৩টার দিকে মুহূর্তের মধ্যেই নিচতলার ১২টি ঘর পানিতে ডুবে গেছে। ভবনের
বাসিন্দারা কেউ কেউ সাঁতরে তীরে উঠে আসতে পারলেও সলিল সমাধি হয়েছে বহু
মানুষের। রাত সাড়ে ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্থানীয় জনতা ও ফায়ার
সার্ভিস কর্মীরা ১২ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। তাদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিখোঁজ ও নিহতদের স্বজনের আহাজারিতে গোটা এলাকার
পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। অবতারণা হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। ঘটনার তদন্তে তিন
সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। মর্মান্তিক এ ঘটনায় শোক
জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরিন শারমিন
চৌধুরী জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ ও বিএনপি
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
ফায়ার
সার্ভিস সদর দফতরের ইন্সপেক্টর নিলুফার ইয়াসমিন যুগান্তরকে জানান, বেলা
সাড়ে ৩টায় তারা ঘরগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ার খবর পান। ঘটনাস্থলে ফায়ার
সার্ভিসের ৯টি ইউনিট পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করে।
www.24banglanewspaper.com তিনি আরও বলেন, ডুবে
যাওয়ার সময় ভবনের অধিকাংশ বাসিন্দা তখন বিশ্রামে ছিল। ফলে বড় ধরনের
প্রাণহানির আশংকা করা হচ্ছে। সব ঘর সরিয়ে ‘ফাইনাল সার্চ’ না দেয়া পর্যন্ত
নিশ্চিত করে বলা যাবে না সেখানে আর কত লাশ আছে। তিনি আরও জানান, রাত সাড়ে
৯টার সময় মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ঠিকাদারি প্রতি¯¤ান তমা কনস্ট্রাকশনের
একটি ও ফায়ার সার্ভিসের একটি ক্রেন এনে ঘরগুলো টেনে তোলার কাজ শুরু হয়। রাত
১২টা পর্যন্ত ঘরটির অর্ধেকের বেশি অংশ সরিয়ে নেয়া হয়। তবে সেখানে নতুন করে
কোন লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।ফায়ার
সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এম শাকিল নেওয়াজ খান জানান, এলাকার
পরিস্থিতি ও কাঠামোগত সমস্যার কারনে উদ্ধারকাজে সমস্যা হচ্ছে। বাড়িটি ডোবার
ওপর। চার পাশে ডোবা। ডোবার পানি পঁচা, দুর্গন্ধযুক্ত। এতে যাতায়াত ও
সেখানে অবস্থান করতে সমস্যা হচ্ছে। উদ্ধার কাজে ব্যবহারের জন্য তারা
অত্যাধুনিক চেইন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।ফায়ার
সার্ভিসের ডুবরি মাসুদল হক ও আলমগীর হোসেন উদ্ধার অভিযান চালাকালে
যুগান্তরকে জানান, তারা প্রথম তলার ৫টি কক্ষে চালের টিন কেটে দুই নারীর লাশ
বের করে এনেছেন। ঝিলটি সাত থেকে আট ফুট গভীর। ঘরের প্রতিটি কক্ষ
হাঁড়ি-পাতিল, চৌকি-খাট, আলনা, জামা-কাপড়, লেপতোশক, টেলিভিশন, ব্যাগ, বস্তা,
খুঁটি, কাঠের টুকরা, তক্তা, লাঠিসহ বিভিন্ন মালামালে ঠাসা। পচা পানির
কারণে ওইসব ঘরের ভেতর প্রবেশ করা ও তল্লাশি করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে কোনো লাইট পানির নিচে কাজ করে
না। ফলে সহজেই উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা একপাশ থেকে
শুরু করে টিন সরিয়ে ও এঙ্গেল কেটে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন।এই
দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হরিয়েছেন, তারা হলেন- ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া আখের রস
বিক্রেতা বরগুনার নিজাম খাঁ (৪৭) এবং তার স্ত্রী কল্পনা বেগম (৪২) ও ছেলে
সবুজের স্ত্রী রোকসানা (২২), রিকশাচালক মিজানুর রহমান (৩০), স্থানীয় মুদি
দোকানদার বরিশালের হারুণ অর রশিদ (৫৬), ভাঙারি ব্যবসায়ী খলিলুর রহমানের ছোট
ছেলে সাইফুল ইসলাম (১৪), ঝালকাঠির মাসুদের স্ত্রী সাজিদা (১৯), জোস্না
বেগম (৪০), বাড়ির ম্যানেজারের মা রূপসী (৬০), শিশু ফারজানা (৯), গার্মেন্টস
কর্মী রুনা (২৩) ও সিএনজি চালক জাকির (৩০)। দুর্ঘটনায় আহতদের খিলগাঁওয়ের
খিদমাহ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিকে
নেয়া হয়েছে।ওই বাড়ির নিচতলার
বাসিন্দা গার্মেন্টকর্মী হাসি বেগম ও জুতার দোকানের কর্মী ইদ্রিস আলী
জানান, বেলা ৩টার দিকে কয়েকবার ঘরটি নড়ে উঠে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরটি
মুহূর্তের মধ্যেই ঝিলের পানির নিচে তলিয়ে যায়।হাসি
তার নাতি ও মেয়েকে নিয়ে কোনো মতো সাঁতরে বের হয়ে আসেন। ইদ্রিস আলী জানান,
তিনি বের হয়ে আসতে পেরেছেন; কিন্তু স্ত্রী ও নাতনী আটকা পড়েছে।অপর
বাসিন্দা রোজিনা খাতুন জানান, তার শাশুড়ি ফাতেমা. শ্বশুর শহিদুল, ছোট তিন
দেবর জাহিদ, ইউসুফ ও এনামউদ্দিন নিচতলার একটি কক্ষে চার হাজার টাকায় ভাড়া
থাকতেন। ঘর ডুবে যাওয়ার পর টিন কেটে শ্বশুর শহিদুল, দেবর জাহিদকে উদ্ধার
করা হয়েছে। তার শ্বশুর রাজমিস্ত্রির কাজ করেন বলে জানান রোজিনা।অপর
ঘরের বাসিন্দা খলিলুর রহমান জানান, তার ছেলে সাইফুল ইসলাম মারা গেছে। তার
বয়স ১৪। সে স্থানীয় ডিডিএস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ত। খলিল শেখ তার স্ত্রী
শেফালী ও দুই ছেলেকে নিয়ে টিন শেডের ঘরটির নিচতলায় থাকতেন। ছেলেকে হারিয়ে
খলিল ও তরা স্ত্রীর মাতমে কয়েক ঘন্টার জন্য থমকে দাড়িয়েছিল গোটা এলাকা।অপর
বাসিন্দা আলতাফ মিয়া জানান, বেলা পৌনে ৩টার দিকে দুপুরের খাবার শেষে
অনেকেই ফিরে গেছেন নিজ নিজ কাজে। আবার অনেকে নিচ্ছিলেন বিশ্রাম। ঠিক তখনই
ঘটে গেল মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা। সবাই আল্লাহগো বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু
করেন। তিনি দোতলা থাকায় বের হয়ে আসতে পেরেছেন। ঘর ধসে পড়ার খবরে হাজার
হাজার উৎসুক মানুষ ঘটনাস্থলে যান। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে শুরু করেন উদ্ধার
কাজ।নিহত রুনা ও জাকিরের বোন ফাতেমা
নাসরিন আক্তার জানান, গত মাসে তারা ওই বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষ ৫ হাজার
টাকায় ভাড়া নেন। আগামী মাসে তাদের অন্য বাসায় চলে যাওয়ার কথা ছিল। হাঁটতে
গেলেই বাড়িটি নড়াচড়া করত। কয়দিন আগেও ঝড়ের সময় খুব ভয় পেয়েছিলেন। ঘটনার সময়
তিনি দোতলায় ছিলেন। তার স্বামী খোকন, আর রুনা ও জাকির ছিল নিচতলায়
থাকতেন।স্থানীয় বাসিন্দা হোসেন আলীর
অভিযোগ, প্রায় ১৫ একর আয়তনের বউবাজারের ঝিলটি খাস জমির ওপর নির্মিত।
স্থানীয় যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান কোন অনুমতি না নিয়েই ঘরগুলো নির্মাণ
করেন। ঘরগুলো অনেক আগ থেকেই ঝুকিপূর্ণ ছিল। এছাড়া ওইসব ঘরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস
লাইন ছিল অবৈধ।উদ্ধার কাজের অগ্রগতি
আশানুরুপ না হওয়ায় স্থানীয়রা রাত ১১ টার দিকে বিক্ষোভ করেন। তারা বলেন,
ফায়ার সার্ভিস ইচ্ছে করে উদ্ধার কাজে বিলম্ব করছে। তারা চাইলে আরও আগেই
ক্রেন এনে উদ্ধার কাজ চালাতে পারতো। এতে আটকে পড়া কেউ থাকলে জীবিত উদ্ধার
করা সম্ভব হতো। ঘটনাস্থলে রামপুরা থানার ওসি মাহবুবুর রহমান জানান, উদ্ধার
করা লাশগুলোর নাম-ঠিকানা রেখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।
এঘটনায় মালিক ও ম্যানেজারকে দায়ী করে মামলা হবে বলে জানান তিনি।ঢাকা
জেলা প্রশাসন (ডিসি) তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বুধবার রাতে সোয়া ১০ টায়
ঘটনাস্থলে যান। তিনি যুগান্তরকে টেলিফোনে জানান, এ ঘটনায় জেলা মেজিস্ট্রেট
শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তাদেরকে ৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া দাফন করতে প্রতিটি
লাশের জন্য ২০ হাজার টাকা এবং চিকিৎসার জন্য আহত প্রতি জনকে ৫ হাজার টাকা
দেয়া হবে।রাতে ঘটনাস্থলে স্বরাষ্ট্র
সচিব এসএম মোজাম্মেল হক ঘটনাস্থলে গিয়ে দায়ীদের শাস্তির জন্য বলেছেন। - See
more at: