ওরা প্রথম নারী সামরিক বৈমানিক
বাবা-মা উভয়েই চেয়েছিলেন আমি বৈমানিক হব : তামান্না-ই-লুৎফি ছেলেবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল পাখির মতো আকাশে ওড়ার। বাবা-মা উভয়েই চেয়েছিলেন আমি বৈমানিক হব। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগদানের তিন বছর পর সেই সুযোগ এল। তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হল। ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর, বেলা ১১টা। সেই মহেন্দ্রক্ষণটি আমার জীবনে বাস্তব রূপ নেয়ার মুহূর্তে মনের ভেতর খুব উত্তেজনাপূর্ণ ভাবাবেগ তৈরি করেছিল। এককভাবে প্রথম আকাশে ওড়ার অনুভূতি এভাবেই বর্ণনা করলেন ফ্লাইং অফিসার তামান্না-ই-লুৎফি।বাংলাদেশ বিমানবাহিনী একাডেমিতে তামান্না-ই-লুৎফি যোগদান করেন ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। যশোরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানে দু’বছর প্রশিক্ষণ শেষে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ৬৬ ফ্লাইট ক্যাডেট কোর্সে কমিশন পান। তার ব্যাচে ২২ জন ফ্লাইট ক্যাডেট ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ৭ জন মেয়ে ফ্লাইট ক্যাডেট। এরপর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অপারেশনাল বাঞ্চে আবহাওয়া কর্মকর্তা হিসেবে কমিশন পান। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বৈমানিকের জন্য আবেদন চাওয়া হয়। ছেলেদের সুযোগ আগেই ছিল। এবার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামুল বারি, এনডিইউ, পিএসসি, বিবিপি মেয়েদের নারী বৈমানিক হওয়ার সুযোগটি করে দেন। ওই বছরের ৩ আগস্ট বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ১৮নং স্কোয়াড্রনে যোগদান করেন তামান্না।তামান্না-ই-লুৎফি বলেন, প্রথমে গ্রাউন্ড প্লাসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শুরু করি। আমার সঙ্গে ছিলেন আরেক প্রশিক্ষণার্থী নাইমা হক। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কীভাবে কি করব। প্রতিদিনই অনুশীলন করি। সহকর্মী, প্রশিক্ষকবৃন্দ বিশেষ করে ১৮নং বহরের অধিনায়ক উইং কমান্ডার আহমেদ আসিফ আখতার আমাদের অনেক সহযোগিতা করেন। বিমান চালানোর মতো চ্যালেঞ্জিং কাজটিকে উনারা আমাদের কাছে সহজ করে দিয়েছেন।তামান্নার জন্ম যশোরে। পৈতৃক বাড়ি যশোরের বেনাপোলের গাজীপুর গ্রামে। বাবা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক গ্র“প ক্যাপ্টেন লুৎফর রহমান। মা আয়েশা সিদ্দিকা গৃহিণী। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বড় বোন বুশরা ফেরদাউসি দাঁতের চিকিৎসক, ছোট ভাই আসিফ ইমতিয়াজ এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ঢাকার বিএফ শাহীন স্কুল থেকে ২০০৮ সালে এসএসসি, বিএফ শাহীন কলেজ থেকে ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করেন। বাবার কর্মসূত্রের কারণে ছেলেবেলা থেকেই তিনি দেখেছেন বিমান ওঠা-নামার দৃশ্য। আর স্বপ্ন বুনেছেন যুদ্ধবিমানের ককপিটে বসার।দাদাকে দেখিনি, তার গল্প শুনে বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন দেখি : নাইমা হক২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর, বেলা ১১টা। এককভাবে প্রথম আকাশে উড়লাম। এরপর রাষ্ট্রীয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর শীতকালীন গ্র্যাজুয়েশনে প্রথম ফ্লাই প্লাসে অংশ নিই ৩১ ডিসেম্বর। একা শূন্যে ভেসে বেড়ানোর অনুভূতিই অন্যরকম। এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি যা আমাকে আলোড়িত করে। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। এভাবেই এককভাবে উড্ডয়নের অনুভূতি প্রকাশ করলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক।নাইমা হক, এয়ার অধিনায়কের এয়ার কমোডর সাঈদ হোসেন, এয়ার কমোডর হাসান মাহমুদ এবং ১৮নং বহরের অধিনায়ক উইং কমান্ডার আহমেদ আসিফ আখতারের তত্ত্বাবধানে আকাশে ওড়েন। এ জন্য অবশ্য তাকে গ্রাউন্ডে অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। প্রস্তুতির মধ্যে ছিল- শারীরিক যাচাই-বাছাই, গ্রাউন্ড প্লাস, আকাশে ওড়ার জন্য আবহাওয়া, প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে ব্রিফিং নেয়া। প্রশিক্ষণের শুরুটা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম নারী সামরিক বৈমানিক হিসেবে ২৩ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় ১ ঘণ্টার মিশন ছিল। সঙ্গে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার বাশার।নাইমা হক বলেন, যশোরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ১৮ নম্বর স্কোয়াড্রনে আমার সঙ্গে তামান্না-ই-লুৎফিও প্রশিক্ষণে অংশ নেন। আমাদের উড্ডয়ন প্রশিক্ষক এবং পথ নির্দেশক ছিলেন বাশার, শাহ আলম, উইং কমান্ডার আহমেদ আসিফ আখতার। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট আমাদের মাঠপর্যায়ের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩/৪টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলত। সন্ধ্যাবেলায় নিজেদের কক্ষে এসে পরের দিনের প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নিতাম। ২৩ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো আমরা আকাশে উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ শুরু করি। বেল-২০৬ হেলিকপ্টারে ২৫ ঘণ্টা উড্ডয়ন শেষে একক উড্ডয়ন সম্পন্ন করি। নাইমা হক বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন ২০১০ সালে। এরপর দু’বছর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী একাডেমি ৬৪নং ফ্লাইট ক্যাডেট কোর্সের অধীনে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। এ কোর্সে ২২ জন ফ্লাইট ক্যাডেটের মধ্যে ৯ জন ছিলেন মেয়ে ফ্লাইট ক্যাডেট। প্রথমে আবহাওয়া কর্মকর্তা হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামুল বারি, এনডিইউ, পিএসসি, বিবিপি মেয়েদের নারী বৈমানিক হওয়ার সুযোগটি করে দেন। ওই বছরের ৩ আগস্ট বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ১৮নং স্কোয়াড্রনে যোগদান করেন নাইমা।নাইমা হকের জন্ম ঢাকায়। বাবা এম নাজমুল হক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক উপ-পরিচালক। মা নাসরিন বেগম গৃহিণী। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বড় বোন মনিরা হক সহকারী কমিশনার ভূমি এবং ভাই মোহাম্মদ বদরুল হক বেসিক ব্যাংকের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। বাবা-মা উভয়েই ছেলেবেলা থেকেই তাদের ভাই-বোনদের পড়াশোনা এবং একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি হলিক্রস স্কুল থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি, ২০০৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। বিমানবাহিনীতে যোগদান করে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের অধীনে বিএসি অ্যারোনটিক বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন ২০১৩ সালে।বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাইমা বলেন, আমার দাদা আবদুল ওয়াহেদ খন্দকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইন্ডিয়ান রয়েল এয়ারফোর্সে কর্মরত ছিলেন। দাদাকে দেখিনি, তার গল্প শুনে বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এ ছাড়া আমার বাবা-মা আমার ইচ্ছা পূরণে কখনওই বাধা দেননি। বরং সব কাজেই আমাকে সাহস জুগিয়েছেন।কাজের ব্যস্ততার কারণে নাইমার অবসর নেই বললেই চলে। এরপরও সামান্য সময় পেলে ঘুরে বেড়ানো, বই পড়ে, গান শুনে, ছবি তুলেন।www.24banglanewspaper.com