মানবতাবিরোধী
অপরাধে সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ফাঁসির আদেশ
দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে
মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের
নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যর বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। কায়সারের বিরুদ্ধে আনা
১৬টির মধ্যে ১৪টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি
মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম। এদিকে রায়কে ঘিরে
ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।৪৮৪ পৃষ্ঠার রায়ের
সংক্ষিপ্তসার পড়ে বিচারক বলেন, সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা
১৬টি অভিযোগের মধ্যে ১৪টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।এর আগে সকাল সাড়ে
৮টায় পুলিশি নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে
আসা হয়।মুসলিম লীগের সাবেক নেতা কায়সারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
চলাকালে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, আটক, ধর্ষণ, মুক্তিপণ আদায়, অগ্নিসংযোগ ও
ষড়যন্ত্রের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে ১৬টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ
রয়েছে।সোমবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনাল-২ রায়ের এই দিন ঠিক করে দেয়। দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন
শেষে গত ২০ অগাস্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল।
মামলার কার্যক্রম চলাকালে জামিনে থাকলেও ওইদিন কায়সারকে কারাগারে পাঠানোর
নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মানবতাবিরোধী অপরাধের
মামলার রায় ঘিরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা
জোরদার করা হয়। মঙ্গলবার ভোর থেকেই ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিরাপত্তার
দায়িত্ব পালন করেন প্রায় সাড়ে তিনশ পুলিশ সদস্য। চলতি বছর ২ ফেব্রুয়ারি ১৬
ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে সৈয়দ কায়সারের বিচার শুরু হয়।
এর আগে গতবছর ১৫ মে কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন
ট্রাইব্যুনাল। ওই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিম লীগের এই সাবেক নেতাকে।
এরপর তাকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।২১ মে পুলিশ কায়সারকে
হাসপাতাল থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠান।
আসামিপক্ষের আবেদনে গতবছর ৪ অগাস্ট সৈয়দ কায়সারকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়
ট্রাইব্যুনাল।কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ
প্রসিকিউশনের মোট ৩২ জন সাক্ষী। আসামিপক্ষের আইনজীবী তাদের সবাইকে জেরাও
সম্পন্ন করেন। তবে কায়সারের পক্ষে কোনো সাক্ষী উপস্থাপন করেনি
আসামিপক্ষ।সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের পুলিশ ফাঁড়ি ও ইসলামপুর গ্রামের কাজীবাড়িতে শাহজাহান
চেয়ারম্যানকে হত্যা, নায়েব আলী নামের একজনকে জখম ও লুটপাট। হবিগঞ্জ জেলার
মাধবপুর বাজারের পশ্চিমাংশ ও পার্শ্ববর্তী কাটিয়ারায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ।
করে সৈয়দ কায়সার ও তার লোকজন। কৃষ্ণনগর গ্রামের অহিদ হোসেন পাঠান, চেরাগ
আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে হত্যা।১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল হবিগঞ্জের
মাধবপুর বাজারের উত্তর পূর্ব অংশে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে।২৯ এপ্রিল দুপুর
থেকে বিকালের মধ্যে হবিগঞ্জ সদরের শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্যগুদাম এবং
শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজারের রেলব্রিজ এলাকায় আব্দুল আজিজ, আব্দুল খালেক,
রেজাউল করিম, আব্দুর রহমান এবং বড়বহুলা এলাকার আব্দুল আলী ওরফে গ্যাদা
উল্লাহ, লেঞ্জাপাড়া এলাকার মাজত আলী ও তারা মিয়া চৌধুরীকে আটক করে
নির্যাতনের পর হত্যা। সন্ধ্যার পর পুরানবাজার পয়েন্টে সাবেক প্রধান
বিচারপতি সৈয়দ এ বি এম মহিউদ্দিনের বাড়িতে হামলা। লস্করপুর রেল লাইনের
পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং হীরেন্দ্র চন্দ্র রায়কে
ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা।১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল হবিগঞ্জ সদরের এনএনএ
মোস্তফা আলীর বাড়িসহ ৪০/৫০টি বাড়িঘর, দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ
করে।একই বছর ১১ মে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চাঁদপুর চা বাগানে সাঁওতাল
নারী হীরামনিকে ধর্ষণ করে সৈয়দ কায়সারের বাহিনী। ১৫ মে হবিগঞ্জ জেলার
মাধবপুরের লোহাইদ এলাকার আব্দুল আজিজ, আব্দুল গফুর, জমির উদ্দিন, আজিম
উদ্দিন, এতিমুনেছা, নূর আলী চৌধুরী, আলম চাঁনবিবি ও আব্দুল আলীকে হত্যা।১৩
জুন হবিগঞ্জ সদর, মোকাম বাড়ি, শায়েস্তাগঞ্জ থানার আর এন্ড এইচ ডাকবাংলো এবং
মাধবপুর থানার শাহাজীবাজার এলাকার হামলা, শাহ ফিরোজ আলী ও সাবু মিয়াকে
অপহরণের পর নির্যাতন-হত্যা। ২৩ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হরিপুর থানার
নাসিরনগরের গোলাম রউফ মাস্টার ও তার পরিবারের লোকজনদের উপর নির্যাতন,
বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার দয়াল গোবিন্দ
রায় ওরফে বাদল কর্মকারের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও বাড়িতে
অগ্নিসংযোগ।আগস্টের মাসের মাঝামাঝি সময়ে হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার বেলাঘর ও
জগদীশপুর হাইস্কুল থেকে আতাব মিয়া, আইয়ুব মিয়া, মাজেদা বেগমকে অপহরণ করে।
এক পর্যায়ে মাজেদাকে ধর্ষণ করা হয়।১৮ আগস্ট হবিগঞ্জের নলুয়া চা বাগান থেকে
মহিবুল্লাহ, আবদুস শহীদ, আকবর আলী, জাহির হোসেনকে অপহরণ করে নরপতিতে আব্দুস
শাহীদের বাড়ি ও রাজেন্দ্র দত্তের বাড়িতে স্থানীয় শান্তি কমিটির কার্যালয়
এবং কালাপুরের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার
বাহিনী। অপহৃতদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।১৯৭১ সালের ২৯
সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাধবপুরে সোনাই নদীর ব্রিজ এলাকা থেকে সিরাজ আলী,
ওয়াহেদ আলী, আক্কাস আলী, আব্দুল ছাত্তারকে অপহরণ ও নির্যাতনের পর হত্যা করা
হয়।অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে
শালবন রঘুনন্দ পাহাড় এলাকায় শাহাপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিনকে অপহরণের
নির্যাতন করে হত্যা।সালের ১৫ নভেম্বর ব্রাহ্মণবড়িয়ার ভাটপাড়া থানার দাউরা,
নিশ্চিন্তপুর, গুটমা, বুরুঙ্গা, চিতনা, নূরপুর, ফুলপুর, জেঠাগ্রাম,
পাঠানিশা, কুলিতুণ্ডা, আন্দ্রাবহ, তিলপাড়া, কমলপুর, গঙ্গানগর, বাঘি,
শ্যামপুর, কুয়ারপুর, নোয়াগাঁও, কুণ্ডা, লক্ষীপুর, করগ্রাম গ্রামের ১০৮ জন
গ্রামবাসীকে হত্যা করে।সৈয়দ কায়সারের বাবা সৈয়দ সঈদউদ্দিন ১৯৬২ সালে
সিলেট-৭ আসন থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএলএ নির্বাচিত হন। আর সৈয়দ কায়সার
১৯৭০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ‘স্বাধীনতাবিরোধীকে’ নিয়ে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন
এই মুসলিম লীগ নেতা। তিনি নিজে ছিলেন ওই বাহিনীর প্রধান। তিনি পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দমন অভিযান চালাতেন। পরে স্বাধীনতার ঠিক আগে তিনি
আত্মগোপন করেন।১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৭৮
সালে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন কায়সার। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে
সিলেট-১৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে সাংসদ নির্বাচিত
হন। পরে জিয়াউর রহমানের সময়ে তিনি বিএনপিতে যাগ দেন এবং হবিগঞ্জ বিএনপির
সভাপতি হন।এরশাদের সময়ে তিনি যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ১৯৮৮ সালে হবিগঞ্জ-৪
আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন।www.24banglanewspaper.com